গাংনীতে ছেলের অত্যাচারে বাবা সহ গ্রামবাসী অতিষ্ঠত
এম চোখ ডটকম, গাংনী :
জাল দলিলের মাধ্যমে পিতার জমির দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ছেলে নাজমুল হক টুটুল নামের এক ব্যক্তি। আর এই জমির দখল পেতে নিজের বাবাসহ গ্রামের কয়েকজনের নামে মামলা দিয়ে করে তুলেছে অতিষ্ঠ। মিথ্য মামলায় নিরপরাধ তিন জনের ঠাঁই হয়েছে শ্রীঘরে। এমন অভিযোগ করে নিরপরাধ ব্যক্তিদের মুক্তি ও নাজমুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। আলোচিত এই ঘটনাটি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার ভোলাডাঙ্গা গ্রামের। বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশ তিন জনকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করেছে। যা নিয়ে এলাকার মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে ক্ষোভ।
গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছেন- ভোলাডাঙ্গা গ্রামের রিয়াজ উদ্দীনের ছেলে শফিকুল ও ইউসুফের ছেলে জাফিরুল এবং পিন্টু মিয়া। নাজমুল হক প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে জমি ক্রেতা ও লিজ গ্রহিতাদের নামে মিথ্যা মামলায় হয়রানি করছেন বলে সাক্ষ্য দিচ্ছেন তার পিতা আব্দুল কুদ্দুস। ছেলের এই প্রতারণার ফাঁদ ও অপকর্মের প্রতিবাদ করতে গিয়ে হচ্ছেন হেনস্থার শিকার। প্রায়ই তার ছেলে তাকে মারধর করতে উদ্যত হয় বলে অভিযোগ করে কাঁদলেন ভুক্তভোগী পিতা আব্দুল কুদ্দুস। ছেলের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে নিজ বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিচ্ছেন বিভিন্ন ব্যক্তির বাড়িতে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভোলাডাঙ্গা গ্রামের শফিকুল ইসলাম নিজ গ্রামের আব্দুল কুদ্দুসের কাছ থেকে ৭ কাঠা জমি ক্রয় করেন ২০২০ সালে। সে থেকেই তিনি ওই জমি ভোগদখল করে আসছেন। অপর দিকে গ্রামের জাফিরুল এক বিঘা, পিন্টু মিয়া এক বিঘা ও আব্দুল হান্নান ১০ কাঠা জমি কুদ্দুসের কাছ থেকে লীজ নিয়ে চাষাবাদ করে আসছেন। দীর্ঘদিন ওই জমি নিয়ে কোন সমস্যা না থাকলেও সম্প্রতি আব্দুল কুদ্দুসের ছেলে নাজমুল হক পিন্টু ওই জমি তার নিজের বলে দাবী করে ক্রেতা ও লীজ গ্রহীতাদেরকে ছেড়ে দিতে বলেন।
ওই জমি ছাড়তে নারাজ হওয়ায় নাজমুল হক গাংনী থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন। পুলিশ অভিযোগ আমলে নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতায় পৌছাতে ব্যর্থ হওয়ায় আদালতে প্রসিকিউশন দেন। বিজ্ঞ আদালত মামলাটি গ্রহণ করে চার জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারী করেন। গ্রেফতারি পরোয়ানা পেয়ে গাংনী থানা পুলিশ ক্রেতা শফিকুল ও লীজ গ্রহীতা জাফিরুল এবং পিন্টুকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠায়।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নাজমুল হক টুটুল জানান, শফিকুল ইসলামসহ ভোগদখলকৃত জমি তার পিতা আব্দুল কুদ্দুস ২০১৯ সালে তার নামে দানস্বত্ব করে দেন। ওই জমি কয়েকবার দখলদারকে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ জানালেও তারা কর্ণপাত করেনি। বাধ্য হয়ে তিনি মামলা করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, নাজমুল হক পিন্টু ২০১৯ সালের যে দানস্বত্ত রেজিস্ট্রির কথা উল্লেখ করেছেন সেই দলিলে পিতার জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ভুল ও কাটাছেড়া করা ? পরিচয়পত্রে ভুল নাম্বার এবং কাটাছেড়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি তা এড়িয়ে যান।
অনুসন্ধান কালে নাজমুলের দাবিকৃত দলিলের শনাক্তকারীরে খোঁজ করা হয়। শনাক্তকারী হিসেবে দুই জনের নাম বলেন নামজুল। এরা হচ্ছে- ভোলাডাঙ্গা গ্রামের ইব্রাহিম হোসেন এবং নাজমুলের দুলাভাই দেলোয়ার হোসেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইব্রাহিম হোসেন বলেন, দলিলের বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। এসবের মধ্যে আমি নেই। এদের সাথে আমি কোনভাবে সম্পৃক্তও না। এ বিষয়ে এর বেশি কথা বলতে রাজি হননি তিনি।
এদিকে অপর শনাক্তকারী নাজমুলের দুলাইভাইয়ের মোবাইল নম্বর চাইলে তা এড়িয়ে যান নাজমুল।
নাজমুলের পিতা আব্দুল কুদ্দুস জানান, তিনি শফিকুল ইসলামের কাছে জমি বিক্রি করেছেন এবং জাফিরুল, পিন্টু ও আব্দুল হান্নানের কাছ থেকে টাকা নিয়ে জমি বন্ধক দিয়েছেন। কিন্তু তার ছেলে নাজমুল হক প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। সে ভ‚য়া দলিল করে ওই জমি নিজের বলে দাবী করছেন। আমাকে বাড়ি থেকে ছেলে তাড়িয়ে দিয়েছে। হেঁসো দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করার চেষ্টাও করেছে। বিভিন্ন সময়ে প্রাণনাশে হুমকি দেওয়ায় ছেলের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে পিতা আব্দুল কুদ্দুসের। তবে ছেলে নাজমুল হক টুটুলের বিরুদ্ধে প্রতারণা করে জাল দলিলের মাধ্যমে জমি জালিয়াতির একটি মামলা দায়ের করেছেন পিতা আব্দুল কুদ্দুস। যে মামলাটি বিজ্ঞ আদালতে মামলা চলমান রয়েছে। জমি ক্রেতা ও লিজ গ্রহিতারা নিদোর্ষ। বিষয়টি গ্রামের অনেকেই অবগত। তাই তাদের পক্ষে ছেলের অপকর্মের বিরুদ্ধ আদালতে স্বাক্ষ্য দিবেন বলেও জানান অসহায় পিতা আব্দুল কুদ্দুস।
নাজমুলের দায়েরকৃত মামলার আসামী আব্দুল হান্নানের স্ত্রী তসলিমা খাতুন বলেন, পরের জমি লিজ ও বর্গা নিয়ে চাষ করে এবং কয়েকটি ছাগল পালন করে নিজের জীবিকা নির্বাহ করি। আমার স্বামী ৫ কাটা জমি কুদ্দুসের কাছ থেকে বন্দক নিয়ে চাষ করে আসছিল । বৃহস্পতিবার রাতে হঠাৎ শুনছি আমার স্বামীর নামে মামলা করা হয়েছে। রাতে পুলিশ ধরতে আসলে আমার স্বামী ভয়ে পালিয়ে গেছে। সে অসুস্থ। রাত থেকে আর কোন খোঁজ-খবর পাচ্ছি না। পরিবারের লোকজন পুলিশের ভয়ে আতংকে সময় পার করছেন বলেও জানান তসলিমা খাতুন।
ভুক্তভোগী শফিকুল ইসলামের স্ত্রী শাকিলা খাতুন বলেন আমরা গরিব মানুষ বিভিন্ন জিনিসপত্র করে এবং দায়দেনা লোনের মাধ্যমে টাকা গুছিয়ে ৭ কাটা জমি কুদ্দুসের কাছ থেকে ক্রয় করি। ওই জমিতে চাষ আবাদের মাধ্যমে চলি। হঠাৎ দেখি রাতে একদল বাড়িতে আমার খোঁজ করে। এক পর্যায়ে তাকে ধরে নিয়ে যায়। পরে শুনলাম তার নামে ওয়ারেন্ট হয়েছে। জানতে পারলাম কুদ্দুসের ছেলে গাংনী থানায় একটি মামলা করেছে। পরে সেটা ওয়ারেন্ট হয়। যেটা ছিল পুরো মিথ্যা মামলা। কারণ আমরা জমি প্রকৃত মালিক কুদ্দুসের নিকট থেকে সকল কাগজপত্র যাছাই-বাছাই পূর্বক সরকারী নিয়ম কানুন মেনে রেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে জমিটি ক্রয় করি। এবং দীর্ঘদিন ধরে সেই জমিতে চাষ আবাদ করে আসছি। কুদ্দুসের ছেলে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে মিথ্যা মামলা করেছে। আমার স্বামীকে জেলে পুরে পেশিশক্তির বলে এখন জমি দখলের হুমকি দিচ্ছে। সুবিচারের আশায় সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি।
স্থানীয়রা জানান, ভোলাডাঙ্গা গ্রামের কুদ্দুসের নিকট থেকে ৪ থেকে ৫ জন হত দরিদ্র মানুষ বেশ কয়েক বিঘা জমি বন্ধক নিয়ে চাষবাদ করে। বন্ধক নেওয়া গ্রামের অতি দরিদ্র মানুষগুলো পড়েছে মিথ্যা মামলার বেড়াজালে। যাদের পক্ষে মামলা জাল থেকে বের হওয়া অত্যান্ত কঠিন। বাপ-ছেলের দ্বন্দের বলি হয়ে হয়ে গ্রামের সাধারণ কৃষকরা এখন হাজতবাসে রয়েছেন। বিষয়টি অত্যান্ত ঘৃর্ণিত ও অপকর্মের বহিঃপ্রকাশ বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন গ্রামের বেশ কয়েকজন।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে গাংনী থানার ওসি বানী ইসরাইল জানান, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে নাজমুল হক নামের একজন গাংনী থানায় অভিযোগ দেয়। অভিযোগটি তদন্তকালে উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়নি তাই বিবাদী পক্ষের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন দেন তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তা। আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানার আদেশ তামিল করেছে পুলিশ। তবে মামলাটি তদন্ত করার মধ্য দিয়ে সব কিছুর জট খুলবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।