মেহেরপুরের চোখ ডট কম, ৩১ জানুয়ারী ২০২২:
দেখতে ভেড়ার মতই। জীবনচক্র একই। তবে ভেড়ার চেয়ে আকারে বেশটুকু বড়। তাছাড়া মাংসের পরিমাণ দ্বিগুন প্রায়। স্থানীয়রা তার নাম দিয়েছে ‘গাড়ল’। ভেড়া পালনের সমান খরচে গাড়ল পালনে বেশি লাভ। তাই মেহেরপুর জেলার অনেকে এখন গাড়ল পালনের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। জেলার গণ্ডি পেরিয়ে গাড়ল ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। লাভজনক এই পশু পালন অনেকে পেশা হিসেবেও বেছে নিয়েছেন। গাড়ল পালনে ভাগ্য বদল করেছেন অনেকে।
গাংনী উপজেলার বাঁশবাড়ীয়া গ্রামের আমিনুর রহমান (২৮) পেশায় ছিলেন গাড়ী চালক। পেশা বদল করে গেল দুই বছর ধরে তিনি গাড়ল পালন করছেন। তার খামারে এখন গাড়লের সংখ্যা শতাধিক।
গাড়ল পালন বিষয়ে আমিনুর রহমান জানান, গাড়ী চালানোর কাজ করে সংসার সামলাতে পারছিলেন না আমিনুর। তখন ভিন্ন পেশার কথা মাথায় আসতেই বেছে নেন গাড়ল পালন। নিজ বাড়িতে গাড়লের আবাস তৈরী করে ৩০টি গাড়ল নিয়ে খামারের যাত্রা শুরু করেন। একজন রাখালকে সাথে নিয়ে নিজেই গাড়ল পরিচর্যা করেন। সারাদিন সড়কের পাশে কিংবা মাঠের ফাঁকা জায়গায় চরানোর কাজ করেন তিনি। গাড়ল পালন করে প্রতি বছর তার আয় তিন লক্ষাধিক টাকা। যা দিয়ে দুই ছেলেমেয়ের লেখাপড়া আর সংসারের অন্যান্য খরচ বেশ স্বচ্ছন্দ্যেই চালিয়ে যাচ্ছেন আমিনুর।
আমিনুরের মতো অনেকেই এখন পেশা বদল করে গাড়ল খামার গড়ে তুলেছেন বলে জানায় জেলা প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তর। জেলায় বর্তমানে গাড়ল ও ভেড়া খামারীর সংখ্যা ৫ শতাধিক।
খামারীরা জানান, গাড়লের বিশেষ বৈশিষ্ঠ হচ্ছে এরা পানি জমে থাকা জমির ঘাস খেতে অভ্যস্থ। ঘাস খাওয়ার জন্য ছাগল পানিতে নামে না। তাই গাড়লের খাদ্য চাহিদা পূরণ করা সহজ।

গাড়ল সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেহেরপুর জেলায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মূলত ভেড়া পালন শুরু হয় ২০০২ সালের গোড়ার দিকে। তখন দেশীয় ভেড়া পালন করা হতো। ওই বছরের মাঝামাঝি সময়ে মুজিবনগর উপজেলার তারানগর গ্রামের দবির উদ্দীন ভারত থেকে বড় প্রজাতির দু’টি ভেড়া নিয়ে আসেন। দেশীয় নারী ভেড়ার সাথে ওই প্রজাতির পুরুষ ভেড়ার সঙ্করীকরণ করে যে বাচ্চা উৎপাদন হয় তাতেই আসে বড় সফলতা। তখন একাজে উৎসাহ বেড়ে যায় দবির উদ্দীনের। স্বল্প সময়ের মধ্যেই দবির উদ্দীনের বাড়ি একটি খামারে পরিণত হয়। ভেড়ার চেয়ে আকারে বড় এবং লেজ অনেক বড়। দবির উদ্দীনসহ স্থানীয় খামারীরা এর নতুন নাম দেন ‘গাড়ল’। তখন থেকেই এ পশুর নাম গাড়ল হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে।
গাড়ল পালনকারীরা জানান, গাড়ল বছরে দু’বার বাচ্চা দেয়। প্রতিবারে দুই থেকে তিনটি বাচ্চা প্রসব করে মা গাড়ল ভেড়া। দেশীয় ভেড়ার চেয়ে গাড়ল আকারে প্রায় দ্বিগুণ। প্রাপ্ত বয়স্ক প্রতিটি গাড়লের ৩৫-৫০ কেজি মাংস পাওয়া যায়। দামও বেশি এবং এর মাংস খেতে সুস্বাদু। যেখানে দেশীয় একটি ভেড়ার ২০-২৫ কেজি মাংস মেলে। খাবার, আবাস ও পালন পদ্ধতি দেশীয় ভেড়ার মতই।
গাড়ল পালন বিস্তারের বিষয়ে খামারীরা জানান, প্রথম গাড়ল পালনকারী দবির উদ্দীনের সাফল্যে থেকে মুজিবনগর এলাকায় এখন গাড়ল জাতের ভেড়া পালন শুরু হয় প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে। জেলার পাশাপাশি বিভিন্ন জেলার মানুষ মুজিবনগর থেকে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন গাড়ল ভেড়ার বাচ্চা। প্রতিটি বাচ্চা ৪ থেকে ৬ হাজার এবং প্রাপ্ত বয়স্ক ১৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তারা জানান, দেশীয় ভেড়ার জাত উন্নয়নে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মুজিবনগর এলাকার গাড়ল পালনকারীরা। ভারতীয় বড় জাতের ভেড়ার সাথে দেশীয় ভেড়ার সঙ্করীকরণ (ক্রস) করে উন্নত জাতের ভেড়ার বাচ্চা উৎপাদন করছেন। প্রাণি সম্পদ দপ্তরের পক্ষ থেকে গাড়ল পালন সম্প্রসারণের চেষ্টা করা হচ্ছে। গাড়ল পালনে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছেন খামারীরা। মেহেরপুর জেলার অনেক বাড়িতে দুয়েকটি গাড়ল পালনের পাশাপাশি বাণিজ্যিক খামারের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জেলা প্রাণী সম্পদ অফিসের হিসেবে মতে, জেলার ৫ শতাধিক খামারে ভেড়া ও গাড়লের সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার। স্বল্প জায়গা এবং অল্প খরচে গাড়ল ভেড়া পালন করে অনেকই জমি ও গাড়ি-বাড়ি করেছেন। সংসারে স্বচ্ছলতা এসেছে খামীদের। ছাগল পালনের মতো সহজ পদ্ধতিতে পালন করা যায় বিধায় অনেকেই গবাদি পশু হিবেবে গাড়ল পালনের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান করে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে সহায়ক হচ্ছে।
মেহেরপুর জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা সাইদুর রহমান জানান, দেশে ভেড়ার উন্নত জাত তৈরীর বিষয়ে কোন গবেষণা কিংবা প্রকল্প নেই। তাই চাষিদের এই পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে সারা দেশে গাড়ল ভেড়ার জাত ছড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চলছে। পাশাপাশি জাত উন্নয়ন ও পালন বিষয়ে আগ্রহী খামারী কিংবা কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এ জাত সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে মাংসের চাহিদা পুরনের পাশাপাশি অর্থনীতিতে আরো সুবাতাস বয়ে যাবে বলে আশার কথা শোনান তিনি।
