এম চোখ ডট কম, মুজিবনগর:
মেহেরপুর ঐতিহাসিক মুজিবনগরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কেন্দ্র এখন অন্যতম দর্শনীয় স্থান। যদিও নির্মাণ কাজটি শেষের পথে তথাপিও সেখানে দাঁড়ালে দেখা যায় মুজিবনগর একাত্তরের বাংলাদেশ। একদিকে স্বাধীনতার সূর্যদোয় ভূমি ঐতিহাসিক সেই আম্রকানন অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবল বিষয়গুলো মূর্যাল। বিভিন্ন স্থাপনার মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এখানে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের বিনোদনের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কেও জানতে পারছেন।
পলাশী থেকে মুজিবনগর:
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে পলাশীর আম্রকাননে বাংলা, বিহার উড়িষ্যার স্বাধীনতার সূর্য অস্ত গিয়েছিল। প্রায় ২০০ বছর পর ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল তৎকালীন নদীয়া জেলার আরেক প্রান্ত মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা তথা মুজিবনগর আম্রকাননে স্বগৌরবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্বাধীনতার সূর্য। মুজিবনগর আম্রকাননে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে চোখ মেলেছিল নবজাতক শিশু বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুঞ্জয়ী মন্ত্রে দীক্ষিত বাঙালি যে রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জন করে হাজার বছরের স্বপ্নলালিত এক সার্বভৌম রাষ্ট্র, সে সংগ্রামের আবেগমথিত উৎসবমুখর ছিল মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণের দিনটি। আর তাইতো সেই দিন ও আম্রকানন বাঙালি জাতি সত্ত্বার সঙ্গে মিশে রয়েছে। মুজিবনগরকে স্মরণীয় ও নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতেই এখানে গড়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ভিক্তিক বিভিন্ন স্থাপনা। যা দেখে বিমোহিত হন দেশ বিদেশের হাজারো দর্শনার্থী। এখানে দাঁড়ালেই দেখা যায় একাত্তরের বাংলাদেশ।

মুজিবনগর একাত্তরের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্থাপনা নির্মান:
২০০১ সালে একনেকের সভায় মুজিবগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কেন্দ্র নির্মাণে ৪৫ কোটি ২৫ লাখ ৫২ হাজার টাকার প্রকল্প অনুমোদন পায়। মুক্তিকামী জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সম্বন¦য়ে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল গঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রথম শপথ গ্রহণ, ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহের স্মৃতি, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা সমৃদ্ধ তথ্য এবং নিদর্শন ভবিষৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার লক্ষ্যে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়। যার উদ্দেশ্যে নতুন প্রজন্মের কাছে একাত্তরের বাংলাদেশ তুলে ধরা। এ প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্র।

মানচিত্রটিকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘটনাচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়াও দেখানো হয়েছে যুদ্ধকালীন সময়ে দেশের চারটি পথ দিয়ে শরণার্থী গমন, পাক হায়েনা দ্বারা পাবনার ঈশ্বরদীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ধ্বংস, আসম আব্দুর রবের পতাকা উত্তোলন, শাজাহান সিরাজের ইশতেহার পাঠ, শালদাহ নদীতে যুদ্ধ, কাদেরিয়া বাহিনীর জাহাজ দখল ও যুদ্ধ, শুভপুর ব্রীজে সম্মুখ যুদ্ধ, কামালপুর ও কুষ্টিয়ার মিরপুরের যুদ্ধ, চালনা ও চট্রগ্রাম বন্দর ধ্বংস, পাহাড়তলী ও রাজশাহীর হত্যাযজ্ঞ, জাতীয় শহীদ মিনার ধ্বংস, সচিবালয়ে আক্রমণ, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণ, জাতীয় প্রেসক্লাব ধ্বংস, তৎকালীন ইপিআর পিলখানা আক্রমণ, রায়েরবাজার বধ্যভূমি ও বুদ্ধিজীবী হত্যার চিত্র। এ মানচিত্রের দিকে তাকালে বোঝা যায় একাত্তরের বাংলাদেশ কি রকম ছিল।
মানচিত্রের দক্ষিণে রয়েছে যাদুঘর। সেখানে স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত গ্রন্থসমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, সেমিনার কক্ষ, মিলনায়তন, স্মৃতিকেন্দ্রের অফিস ভবন, গ্রন্থভাণ্ডার ও বিক্রয় কেন্দ্র নির্মাণ, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ৪০টি আবক্ষ ভাস্কর্য নির্মাণ, জাতীয় নেতৃবৃন্দের তৈলচিত্র, মিলনায়তন ভবনের গায়ে টাইলসের মুর্যালচিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের ঋতুকে দৃশ্যমান করে তোলা, ফোয়ারা নির্মাণ, স্বাধীন বাংলার পতাকা’র প্রতীকৃতি, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল খোদাই করে লিপিবদ্ধ করা, মুজিবনগর সরকারের প্রতীক নির্মাণ এবং টাইলসের ফলকে মুজিবনগর সরকারের প্রচারপত্র নির্মাণ সংযুক্ত করা।

মানচিত্রের দক্ষিণপাশ ঘেষে রয়েছে এন্টি ফাংগাস টাইলস দিয়ে প্রতীকি বঙ্গপোসাগর। মানচিত্রের বাইরে নির্মাণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ মুর্যাল, ২৫ মার্চের কালরাত্রি, মুক্তিকামী মানুুষের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, পাকবাহিনীর নারী নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠান, ১২ আনসার কর্তৃক অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান ও সেক্টর বণ্টন সহ আরোরা নিয়াজী এবং একে খন্দকারের উপস্থিতিতে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের ভাস্কর্য। এসব স্থাপনার দিকে মনোযোগ দিলে সহজেই বোঝা যায় একাত্তরের বাংলাদেশ।
এছাড়াও আম্রকাননের শপথের স্থানে রয়েছে স্মৃতি সৌধ। যা স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি ধাপ ও ইতিহাসের স্বাক্ষ্য বহন করছে। এছাড়াও সারি সারি আম গাছের নৈস্বর্গিক পরিবেশ যেকোন দর্শনার্থীকেই বিমোহিত করে।
মুজিবনগর শুধু ইতিহাসের জন্যই নয় সুখ সাগর পেঁয়াজের জন্যও বিখ্যাত।
দর্শনার্থীদের মাঝে একাত্তরের বাংলাদেশ তুলে ধরা :
বিভিন্ন সময়ে আসা দর্শনার্থীরা জানান, প্রতিবছরই এখানে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা বেড়াতে আসেন। ইতিহাসের পাতা থেকে যা শিক্ষার্থীদের শেখানো হয়েছে মাত্র একদিনে সেই সকল শিক্ষার্থীরা স্মৃতি কেন্দ্র থেকে তা শিখতে পারেন। নির্মাণ কাজ শেষ হলে পর্যটকরা আরো বিস্তারিত জানতে পারবেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ থেকে জানতে পারবেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মানচিত্র নির্মাণকারী ঠিকাদারি ঢাকার জেবিবি প্রতিষ্ঠান ২০০৫ সালে পূর্ণাঙ্গারুপে কাজ শুরু করলেও মাঝপথে সরকারের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নকশার কিছুটা পরিবর্তন এবং সংযোজন বিয়োজন করা হয়। এতে নির্মাণ কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ায় এখনও নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। বর্তমান সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর আবারও কিছু নকশার পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর জন্য বাড়তি অর্থও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। চলতি বছরের মধ্যে নির্মান কাজ শেষ করার আশা করছেন মেহেরপুর গণপূর্ণ অধিদপ্তর।

মেহেরপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে আরও জানতে পারেন।
1 comment
[…] একাত্তরের বাংলাদেশ […]