বাদুড় চোখে দেখে না, কান দিয়ে শুনে চলাফেরা করে ? এ ধারণাটি সম্পূর্ণ সত্যি নয়। দৃষ্টি সম্পন্ন চোখ রয়েছে এদের। তাহলে কেন চোখে দেখে না ? এমন প্রশ্ন শোনা যায়। প্রকৃতপক্ষে নিশাচর অনেক প্রাণীর মতো বাদুড় এর দৃষ্টি অতো প্রখর নয় তবে মানুষের চোখের চেয়ে প্রখর। এদের কান শব্দত্তর তরঙ্গের শব্দ শুনে চলাফেরা করে।
মেহেরপুর জেলায় এক সময় বিভিন্ন প্রজাতির বাদুড় দেখা গেলেও এখন তা অনেকটাই বিরল। মেহেরপুর-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কের মেহেরপুর সদর উপজেলার গোপালপুর গ্রামে দেখা মিলবে বাদুড়। সড়কের দুই পাশে উঁচু দু’টি শিমুল গাছের ডালে ঝুলে থাকা দর্শণীয়। উল্টে হয়ে ঝুলে খেলা করার দৃশ্য পথচারীদের মুগ্ধ করে। দিনের বেশিরভাগ সময় কয়েকশ বাদুড় গাছ দু’টিতে ঝুলে থাকে।
এদিকে প্রতি বছর ফলের মৌসূমে জালে আটকে বাদুড় মরার দৃশ্য দেখা যায়। প্রতি বছর মেহেরপুর জেলায় ফল বাগান বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা বাদুড়ের জন্য খাদ্যের জোগান। কিন্তু ফল ঠেকানোর জন্য বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা জাল দিয়ে ঘিরে রাখেন। এই জালে আটকে অনেক সময় বাদুড় মারা যায়। তবে আশার কথা হলো এখন বাদুড় শিকারিদের দৌরাত্ব নেই।
বাদুড় পরিচিতি:
ছাতার মতো দু’টি ডানা দিয়ে বাদুড় ওড়াউড়ি করে। পাখির মতো উড়তে পারলেও এরা পাখি নয়। বাদুড় হচ্ছে স্তন্যপায়ী প্রাণি। পৃথিবীর একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণির নামই হচ্ছে বাদুড়। চামচিকা দেখতে বাদুড়ের মতই। তবে এরা বাদুড়ের জ্ঞাতি ভাই।
বাদুড়ের ডানা আসলে পাখির ডানার মত নয়। তাদের ডানাকে বলে প্যাটাজিয়াম। বাদুড়ের আঙ্গুল রয়েছে। দেহের চামপড়ার বর্ধিত অংশ হয়ে বুক ও পিঠের পাশর্^দেশ পর্যন্ত ঢেকে কনুই পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অতিরিক্ত চামড়ার আবরণ এদের হাতের সাথে তাই ডানার মতই দেখা যায়।
ইংরেজী নাম:
বাদুড়ের ইংরেজী নাম ইধঃ. ইংরেজীতে আরও একটি নাম আছে। তা হলো ঋষুরহম ভড়ী যার বাংলা উড়ন্ত শৃগাল। নামের সাথে মিলও আছে। এদের মাথাটা কেটে নিলেই শেয়ালের মতই দেখায়। এদের রয়েছে খোরগোসের মতো দু’টি কান। তীক্ষè ধারালো শক্ত দাঁত খাদ্য গ্রহণে খুবই সহায়তা করে।
পরিবেশ রক্ষায় বাদুড়:
যদিও বাদুড়ের খাবারের একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে বিভিন্ন ফল। তবে ফুলের মধু এদের কাছে খুব প্রিয়। এই মধু খাওয়ার মাধ্যমে ফুলের পরাগায়ন হয়ে ফুল থেকে ফলে পরিণত হয়। বিজ্ঞানীদের তথ্য মতে, পৃথিবীর প্রায় ২০ ভাগ ফুলের পরাগায়ন হয় বাদুড়েরর মাধ্যমে। এছাড়াও বিভিন্ন পোকামাকড় খেয়ে জীবন ধারণ করে বাদুড়। বিশেষ করে বাদুড়ের একটি প্রজাতি মশা খেয়ে জীবন ধারণ করে।
বন তৈরীতে বাদুড়:
আমরা যে গাছপালাকে বলি যে প্রাকৃতিকভাবেই জন্মেছে সেগুলোর পেছনে বাদুড়সহ বিভিন্ন পাখির ভুমিকা আছে। পৃথিবীর বড় বড় রেইন ফরেস্ট গড়ে তোলার পেছনে বাদুড়ের অংশ গ্রহণ অনস্বীকার্য। এরা বিভিন্ন ফল খেয়ে বীজ ফেলে দেয়। এছাড়াও তাদের মূত্রত্যাগের মাধ্যমে বীজ ছড়িয়ে তা থেকে গাছগাছালির জন্ম হয়। এভাবে বন জঙ্গল বৃদ্ধি হয়।
বাদুড় ভাইরাস ছড়ায় :
বাদুড় এর জীবন যাপন দেখে নিরিহ প্রাণি মনে হলেও আসলে তা নয়। নভেল করোনা ভাইরাস, মার্স, সার্স, মারবার্গ হেন্দ্রা, ইবোলা ও নিপাহ ভাইরাসের মতো প্রাণঘাতি ভাইরাস ছড়ায়। এদের প্রজাতির আধিক্য, উড়তে পারার ক্ষমতা, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচার ভাইরাস বহনের উপযোগী। বরফাচ্ছাদিত এন্টার্কটিকা মহাদেশ ব্যতিরেকে পৃথিবীর সব জায়গাতে বাদুড় বাস করে। হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে বাদুড় তার সহজাতিদের সাথে একত্রিত হয়। বিভিন্ন প্রজাতির বাদুড় একত্রিত হওয়ার ফলে ভাইরাস বহন ও ছড়াতে সহায়তা করে।
প্রায় ৩০ বছর বাঁচে এই প্রাণি। দীর্ঘ জীবন আর বিশেষ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ফলে বহনকৃত ভাইরাসে বাদুড় এর কোন ক্ষতি হয় না। জার্মানি জীববিজ্ঞানি স্টেফোন ক্লোসে বেশ কয়েক বছর ধরে ঘানার একটি গুহাতে গবেষণা করেছেন। বাদুড়ের ভাইরাস ছড়ানো ও কিভাতে তা আটকানো যায় তা নিয়ে গবেণার ফলাফলে বিস্তারিত প্রকাশ করেছেন এই জীববিজ্ঞানী।
জেনে নিতে পারেন ফিঙে পাখি সম্পর্কে
বাদুড় শব্দ তরঙ্গ দিয়ে পথ চলে :
চোখে দেখার চেয়ে কানে শোনার উপরে বাদুড় বেশি নির্ভর করে। চলার সময় এক প্রকার শব্দ বাতাসে ছড়িয়ে দেয় এরা। ঘরবাড়ি, গাছপালা, পাহাড়-পর্বত কিংবা বড় কোন কিছুতে বাধা পেয়ে প্রতিফলিত হয়ে বাদুড়ের কানে তা ফিরে আসে। তাদের মস্তিষ্ক এতোটাই উন্নত যে ওই প্রতিফলিত হওয়া শব্দ থেকে দ্রুত চলার পথের নিশানা চিহ্নিত করতে পারে। তাদের মস্তিষ্ক বুঝতে পারে বাধা কতো দূরে। কোন দিকে গেলে বাধা ছাড়াই সে পথ চলতে পারবে।
বাদুড় কেন রাতে চলে :
দিনের বেলায় মানুষ, যানবাহন, কলকারখানাসহ বিভিন্ন মাধ্যমের শব্দ বেশি থাকে। ওড়াউড়িতে বাদুর চোখের চেয়ে কানের উপর বেশি নির্ভরশীল। দিনে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া কোটি কোটি শব্দের মধ্যে বাদুড়ের শব্দ প্রতিফলিত হতে বাধা পায়। পথচলার ক্ষেত্রে বাদুড়ের ছড়িয়ে দেওয়া বিশেষ তরঙ্গ বাধাগ্রস্থ হয়। এজন্য বাদুড় রাতের বেলা চলাচল বেছে নেয় বলে বিজ্ঞানিরা গবেষণায় বের করেছেন।
পরিবেশের ভারসম্য রক্ষা করে মানুষের উপকার করছে বাদুড়। প্রকৃতির অন্তর্নিহিত সৃজনখেলার মাধ্যমে সৃষ্টি বাঁচে। তা না হলে পৃথিবীতে বিপর্যয় নেমে আসতো।
বাদুড়ের জীবপন যাপনের ভিডিও দেখুন।
-মাজেদুল হক মানিক