কাঠালের পুষ্টি উপাদান ॥ গাংনীতে কাঁঠাল গাছগুলিতে ছেঁয়ে আছে ঝুলন্ত কাঁঠালে
মজনুর রহমান আকাশ:
জাতীয় ফল কাঁঠাল। ফলের রাজা হিসেবেও সবার কাছে সমাদৃত। এটি শুধুমাত্র একটি মৌসুমী ফলই নয়- কাঠালের পুষ্টি উপাদান রয়েছে এবং অর্থকরী ফসল হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। মেহেরপুরের গাংনীর সর্বত্র এখন কাঁঠাল গাছগুলিতে ঝুলন্ত কাঁঠালে ছেঁয়ে আছে। কোন কোন এলাকায় আগাম জাতের কাঁঠালগুলি পাঁকতে শুরু করেছে।
পাঁকা কাঁঠালের মিষ্টি গন্ধে কীট পতঙ্গরা ভিড় করছে গাছে গাছে। আর সেই আনন্দে বাগান মালিকরা গাছ পরিচর্যায় ব্যস্ত। তবে কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাত করণের কোন সুবিধা না থাকায় এ এলাকার মানুষেরা চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে।
এ লেখার মাধ্যমে একটি এলাকার কাঠাল গাছের তুলনামূলক চিত্র, কাঠালের পুষ্টি উপাদান ও কাঠাল খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে জানতে পারবেন।
খাদ্য নিয়ে প্রথম আলোর নিউজ ভয়াবহ খাদ্যসংকটের মুখে শ্রীলঙ্কা
গাংনী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কাঁঠাল গাছগুলো ফলে ফলে ভরে গেছে। প্রতিটি গাছে ১০০ থেকে ২০০ পর্যন্ত ফল ধরেছে। বছর দশেক আগেও আম কাঠালের বাগান ছিল। এখন শুধু আমের বাগান রয়েছে। এখানকার অধিকাংশ কাঁঠাল গাছ বাগানভিত্তিক না। বাড়ির আঙ্গিনায়, রাস্তার দুই ধারে, স্কুল-কলেজ চত্বরে প্রচুর কাঁঠাল গাছের দেখা মেলে। অভাবের কারণে অনেকে কাঁঠালের গাছ বিক্রি দিচ্ছে।
এদিকে আসবাবপত্র প্রস্তকারী ও ব্যবসায়ী এসব নামমাত্র মূল্যে কিনে ফায়দা লুটছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। কাঠালের পুষ্টি উপাদান বিবেচনায় মানুষ সেভাবে গ্রহণ করে না। মৌসূমি ফল হিসেবে কাঠালের পুষ্টি উপাদন মানুষের শরীরের জন্য খুবই দরকারী বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তাই এ হিসেবে কাঠাল খাওয়ার উপরে জোর দিলেন তারা।

কাটা জাতীয় ডালপালা দিয়ে কাঠালের নিরাপত্তা দিয়েছেন গাছ মালিক।
কাঁঠাল ব্যবসায়ীরা জানান, হাট-বাজারগুলোতে পাঁকা কাঁঠাল উঠতে শুরু করেছে। অনেকেই আছেন প্রতি বছরই প্রায় এক থেকে দেড় লক্ষাধিক টাকার কাঁঠাল বিক্রি করেন। দুই থেকে তিন মাস কাঁঠালের ভরা মৌসুম। এ সময় পাইকার ও শ্রমিক শ্রেণির লোকদের বাড়তি আয়ের সুযোগ হয়। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় কাঁঠালের ফলনও ভালো হয়েছে। গত বছরে কাঁঠাল কম ধরেছিল তাই দাম একটু বেশি ছিল। এবার অনুকুল আবহাওয়ার কারণে ফলন বেশি হয়েছে। তাই অনেক কম দামে কাঁঠাল পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছে ব্যবসায়িরা।
এলাকার অনেকেই মন্তব্য করেছেন, অন্যান্য ফল ও গাছ নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যত তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়, কাঁঠাল নিয়ে তার সিঁকি ভাগও হয় না। অথচ কাঠাল একটি অর্থকরী ফসল ও জাতীয় ফল। কাঠালের পুষ্টি উপাদন অন্যান্য ফলের চেয়ে কম নয়। কোন পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় ও অবাধে কাঠাল গাছ নিধন হওয়ায় এখন কোন বাগান পাওয়া যায় না। বাড়ির আঙ্গিনাতে বা রাস্তার ধারে অনেকেই গাছ লাগান। সরকার একটু নজর দিলেই অনেকেই কাঠাল বাগানে উদ্বুদ্ধ হতো।
উপজেলা কৃষি অফিসার লাভলী আকতার জানান, কৃষিপণ্য কাঁঠাল মুলত একটি মৌসুমী সুস্বাদু ফল। কাঠালের পুষ্টি উপাদন দেশের মানুষের জন্য খুৃবই প্রয়োজনীয়। কাঁঠালের বিচি তরকারীতেও সমান জনপ্রিয়। এলাকায় কোন কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাত করার বাবস্থা না থাকায় কৃষকরা তাদের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাত ব্যবস্থ›া গড়ে তুললে এ উপজেলার মানুষ অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবে।
কাঠাল এর ছবি

গাংনী উপজেলায় সড়কের পাশে এখাবেই কাঠাল ধরার চিত্র দেখা যায়।
আরও পড়ুন সুপার ফুড চিয়া
কাঠাল খাওয়ার উপকারিতা
মানুষের শরীরের অনেক পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন। একেক মৌসূমে একেক ফল পাওযা যায়। তাই শরীরের প্রয়োজনীয় পূরণের জন্য কাঠাল খাওয়া অত্যান্ত জরুরী। এমনটি জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা। বিশেষ করে আলসার, ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ এবং বার্ধক্য ও রাতকানা প্রতিরোধে কাঠাল খাওয়া খুবই জরুরী।
কাঠালে কি কি ভিটামিন আছে
নানান পুষ্টিগুণে ভরপুর কাঁঠাল। কাঁঠালে বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন এ, সি, বি-১, বি-২ পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়ামসহ নানা রকমের পুষ্টি ও খনিজ উপাদান পাওয়া যায়। এই সকল উপাদান আমাদের শরীরকে সুস্থ ও সবল রাখতে সাহায্যে করে। এর পাশাপাশি ভিটামিনের চাহিদাও পূরণ করে কাঁঠাল। ।
আসুন দেখে নেওয়া যাক্র কাঠালের পুষ্টি উপাদন। এখানে উল্লেখ্য যে পাঁকা ও কাঁচা কাঠালের পুষ্টি উপাদান ভিন্ন। এছাড়াও কাঠারে বিচিতেও পুষ্টিগুন রয়েছে। এগুলো নিম্নে ছকের মাধ্যমে দেখানো হলো।
পুষ্টি উপাদান | কচি কাঁঠাল | পাকা কাঁঠাল | কাঁঠালের বীচি |
পানি (গ্রাম) | ৭৬.২০-৮৫.২০ | ৭২-৯৪ | ৫১-৬৪ |
আমিষ (গ্রাম) | ২-২.৬০ | ১.২০-১.৯০ | ৬.৬০-৭.০৪ |
শ্বেতসার(গ্রাম) | ৯.৪০-১১.৫০ | ১৬-২৫.৪০ | ২৫.৮০-৩৮.৪০ |
চর্বি (গ্রাম) | ০.১০-০.৬০ | ০.১০-০.৪০ | ০.৮০-৮০ |
আঁশ (গ্রাম) | ২.৬০-৩.৬০ | ১.০০-১.৫০ | ১.০০-১.৫০ |
খনিজ দ্রব্য (গ্রাম) | ২.৬০-৩.৬০ | ০,৮৭-০.৯০ | ০.৯০-১,২০ |
ক্যালসিয়াম (মি.গ্রাম) | ০.৯০ | ০-৩৭.০০ | ৫০ |
ম্যাগনেসিয়াম (মি.গ্রাম) | ৩০-৩.২০ | ২২৭ | ২৮ |
ফসফরাস (মি.গ্রাম) | ২০-৫৭.২০ | ৩৮-৪১ | ৩৮-৫৭ |
পটাশিয়াম (মি.গ্রাম) | ২৮৭-৩২৩ | ১৯১-৪০৭ | ২৪৬ |
সোডিয়াম (মি.গ্রাম) | ৩-৩৫ | ২-৪১ | ৬৩.২০ |
আয়রন (মি.গ্রাম) | ০.৪০-১.৯০ | ০.৫০-১.১০ | ১.৫০ |
থায়ামিন (মি.গ্রাম) | ০.০৫-০.১৫ | ০.০৩-০.০৯ | ০.২৫ |
রাইবোফ্লাভিন (মি.গ্রাম) | ০.০৫-০.২০ | ০-০.৮০ | ০.১১-০.৩০ |
ভিটামিন “সি” (মি.গ্রাম) | ১২-১৪ | ৭-১০ | ১১ |
ভিটামিন “এ” (আই.ইউ) | ৩০ | ১৭৫-৫৪০ | ১০-১৭ |
খাদ্য শক্তি (কি.ক্যাল.) | ৪৫.৬০-৬১.৮০ | ৬৯.৭০-১১২.৮০ | ১৩৩.২০-১৮৫.৬০ |
তথ্য সূত্র: বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (বারটান) কৃষি মন্ত্রণালয়

গাছের গোড়া থেকে শুরু করে চিকন ডাল পর্যন্ত যেন কাঠালের মিছিল।
কাঠালের উপকারিতা কি
কাঠাল নিয়ে অনেক কিছুই ভাবনা আসতে পারে। কাঠালের পুষ্টি উপাদান ছাড়াও কাঠাল খাওয়ায় আরও উপকারিতা আছে। নিম্নে কাঠালের ২০টি উপকারিতা তুলে ধরা হলো:
১। কাঁঠালে চর্বির পরিমাণ নিতান্ত কম। এই ফল খাওয়ার কারণে ওজন বৃদ্ধির আশংকা কম।
২। কাঁঠাল পটাশিয়ামের উৎকৃষ্ট উৎস। ১০০ গ্রাম কাঁঠালে পটাশিয়ামের পরিমাণ ৩০৩ মিলিগ্রাম। যারা পটাশিয়াম উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। এ জন্যে কাঁঠালে উচ্চ রক্ত চাপের উপশম হয়।
৩। কাঁঠালে প্রচুর ভিটামিন এ আছে, যা রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে।
৪। কাঁঠালের অন্যতম উপযোগিতা হল ভিটামিন সি। প্রাকৃতিকভাবে মানবদেহে ভিটামিন “সি” তৈরি হয় না। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দাঁতের মাড়িকে শক্তিশালী করে ভিটামিন “সি”।
৫। কাঁঠালে বিদ্যমান কাইটোনিউট্রিয়েন্টস- আলসার, ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ এবং বার্ধক্য প্রতিরোধে সক্ষম।
৬। কাঁঠালে আছে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা আমাদের দেহকে ক্ষতিকর ফ্রিরাডিকেলস থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও আমাদেরকে সর্দি-কাশি রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।
৭। টেনশন এবং নার্ভাসনেস কমাতে কাঁঠাল বেশ কার্যকরী।
৮।বদহজম রোধ করে কাঁঠাল।
৯। কাঁঠাল গাছের শেকড় হাঁপানী উপশম করে। শেকড় সেদ্ধ করলে যে উৎকৃষ্ট পুষ্টি উপাদান নিষ্কাশিত হয় তা হাঁপানীর প্রকোম নিয়ন্ত্রণে সক্ষম।
১০। চর্মরোগের সমস্যা সমাধানেও কাঁঠালের শেকড় কার্যকরী। জ্বর এবং ডায়রিয়া নিরাময় করে কাঁঠালের শেকড়।
১১। কাঁঠালে আছে বিপুল পরিমাণে খনিজ উপাদান ম্যাঙ্গানিজ যা রক্তে শর্করা বা চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
১২। কাঁঠালে বিদ্যমান ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়ামের মত হাড়ের গঠন ও হাড় শক্তিশালী করণে ভূমিকা পালন করে।
১৩। কাঁঠালে আছে ভিটামিন বি৬ যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
১৪। কাঁঠালে বিদ্যমান ক্যালসিয়াম কেবল হাড়ের জন্য উপকারী নয় রক্ত সংকোচন প্রক্রিয়া সমাধানেও ভূমিকা রাখে।
১৫। ছয় মাস বয়সের পর থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি শিশুকে কাঁঠালের রস খাওয়ালে শিশুর ক্ষুধা নিবারণ হয়। অন্যদিকে তার প্রয়োজনীয় ভিটামিনের অভাব পূরণ হয়।
১৬। চিকিৎৎসা শাস্ত্র মতে প্রতিদিন ২০০ গ্রাম তাজা পাকা কাঁঠাল খেলে গর্ভবতী মহিলা ও তার গর্ভধারণকৃত শিশুর সব ধরনের পুষ্টির অভাব দূর হয়।
১৭। গর্ভবতী মহিলারা কাঁঠাল খেলে তার স্বাস্থ্য স্বাভাবিক থাকে এবং গর্ভস্থসন্তানের বৃদ্ধি স্বাভাবিক হয়।
১৮। দুগ্ধদানকারী মা তাজা পাকা কাঁঠাল খেলে দুধের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
১৯। এই কল আঁশালো বিধায় কোষ্ঠকাঠিণ্য দূর করে ।
২০। কাঁঠালে রয়েছে খনিজ উপাদান আয়রণ যা দেহের রক্তাল্পতা দূর করে ।
তথ্য সূত্র: বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (বারটান) কৃষি মন্ত্রণালয়
কাঠালের তরকারি
পাঁকা কাঠাল খাওয়ার পাশাপাশি কাঠালের তরকারি বেশ জনপ্রিয়। মেহেরপুর জেলাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ এ তরকারি খেয়ে থাকেন। স্থানীয় হাট বাজারের পাশাপাশি রাজধানীর বাজারগুলোতেও কাঁচা কাঠার কেটে বিক্রি করা হয়। ক্রেতারা তাদের চাহিদা মতো কাঠাল কেনে তরকারির জন্য।
কাঠালের বিচি ভর্তা
কাঠালের বিচি ভর্তা আরেকটি জনপ্রিয় খাবার। বিশেষ করে গ্রামের মানুষ কাঠালের পুষ্টি উপাদান বিবেচনা না করলেও সুস্বাদু খাদ্য হিসেবে এটি খেয়ে থাকে। গরম ভাতের সাথে কাঠালের বিচি ভর্তার স্বাদই আলাদা। কাঠালের বিচি খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সেদ্ধ করা হয়। এবার প্রয়োজনীয় লবণ, মরিচ ও সরিষা তেল দিয়ে এ বিচি ভর্তা করা হয়ে থাকে। যা সকলের পক্ষেই করা সম্ভব।
আল্লাহর অশেষ নেয়ামত হচ্ছে মৌসূমি ফল। আমরা একটু খেয়াল করলে দেখতে পায় যে, বছরের নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট রোগের প্রকোপ বেশি থাকে। এই রোগ প্রতিরোধে আল্লাহ প্রদত্ত হচ্ছে মৌসূমি ফল। কাঠালের পুষ্টি উপাদান বিবেচনা করলেই বিষয়টি আরও পরিস্কার হবে। এ লেখার মাধ্যমে আমাদের দেশের মানুষের কাঠাল খাওয়া বৃদ্ধি ও কাঠাল বাগান করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ঠরা কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এমনটিই প্রত্যাশা।