গাংনীতে সন্তানদের সম্পদ ভাগাভাগির অবহেলার বলির শিকার বৃদ্ধা সাহেরা
এম চোখ ডট কম, গাংনী:
সম্পদ ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে ছেলে মেয়েদের মত বিরোধে মাথা গোজার ঠাই আর পেটের দু’মুঠো ভাতের নিশ্চয়তা নেই বিধবা সাহেরা খাতুনের। পুত্র বধুদের মানষিক নির্যাতন আর মেয়েদের অবহেলা এখন নিত্য দিনের ঘটনা। বাড়ির উঠানে একটি টিনের ছাপড়া ঘরে বৃদ্ধার ঠাঁই মিলেছে। সেখানেই প্রসাব পায়খানা খাওয়া ও গোসলের ব্যবস্থা। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করতে গিয়ে বাক প্রতিবন্ধী এই সাহেরা ধুকে ধুকে মরছে বলে জানালেন প্রতিবেশীরা।
সাহেরা খাতুন মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কল্যাণপুর গ্রামের উত্তর পাড়ার মৃত খেলাফত মণ্ডলের স্ত্রী।
জানা গেছে, বৃদ্ধা সাহেরা খাতুনের বয়স আশির উর্ধে। সংসারে রয়েছে তিন ছেলে ৫ মেয়ে। সকলেই স্বাবলম্বী। বড় ছেলে হকাজ্জেল কৃষক। মেজ ছেলে তুষার ও ছোট ছেলে হানিফ প্রবাসি। স্বামী গত হয়েছেন ১৭ বছর আগে। সন্তানদের বড় করে তুলতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। আশা ছিল সন্তানেরা বৃদ্ধ বয়সে কামাই করে খাওয়াবে আর মৃত্যুর সময় সৃষ্টিকর্তার নামটি কানে দিবে। কিন্তু না, তা হয়নি। হতভাগা মায়ের জিবনে নেমে এসেছে সুখের বদলে দুঃখের ঘনঘটা। পাষণ্ড সন্তানেরা সম্পদ ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে বৃদ্ধ মাকে অনেকটাই বলির পাঠা হিসেবে ব্যবহার করছেন। স্বামীর রেখে যাওয়া জমির দুই আনা অংশ হিসেবে ৫ কাঠা জমি পান সাহেরা। ওই জমির কিছু অংশ বিক্রি করে ২৫ হাজার টাকা পেলে সাহেরার মেয়ে মেহেন্নীগার। সেই সাথে হাতিয়ে নেন মায়ের গলার চেইন ও কানের পাশা।
এদিকে কৌশলে ৫ বোনকে ফাঁকি দিয়ে ৫ কাঠা জমি লিখে নেন তিন ছেলে। মেয়েদের কাছে থাকা অর্থ ও গয়না না পাওয়ায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সইতে হয় সাহেরাকে। অপরদিকে মেয়েরাও কোন খোঁজ খবর নেন না। সব মিলিয়ে সাহেরার জিবনে নেমে এসেছে অন্ধকার। সাহেরাকে ছেলেদের দালান কোঠায় ঠাঁই হয়নি। উঠানের এক কোণে টিনের ছাপড়া ঘরে তাকে রাখা হয়েছে। সেখানেই প্রসাব পায়খানা খাওয়া ও গোসলের ব্যবস্থা। তবে পুত্র বধুরা বলেছেন, বৃদ্ধ আছে বেশ সুখে শান্তিতে।
সাহেরার দেবর হারেজ আলী জানান, সাহেরা খাতুনের স্বামী মারা যাবার পর তিনি নিজেই রান্না বান্না করে খাওয়া দাওয়া করতেন। তার নিজের একটা গাভী ছিল। সেটি বিক্রি করে নগদ ৫০ হাজার টাকা জমা দেন কাউছার মেম্বরের কাছে। সাহেরা অসুস্থ হবার পর ১০ হাজার টাকা খরচ করে। বাকি টাকা রয়ে যায় মেম্বরের কাছে। আবার বয়স্কভাতা প্রাপ্ত টাকা গুলোও সন্তানেরা ভাগ করে নিয়ে নেয়। মায়ের চিকিৎসার জন্য মেম্বরের কাছে টাকাগুলো রাখা হয়েছে বলে জানান তার সন্তানেরা।
প্রতিবেশি বাবলু জানান, মায়ের ভরন পোষণ ও ভাত দেয়ার বিষয়ে তিন ভায়ের মধ্যে সমঝোতা হয়। ১০ দিন করে একেক সন্তান মাকে খাওয়াবে ও যত্ন নিবে। অথচ কেউ সঠিকভাবে তা করেন না। যার কাছেই যাক সেখানেই অবহেলার পাত্র তিনি। ঠিক মতো খাবার দেন না। করেন না গোসলের ব্যবস্থা।
বৃদ্ধার মেজ ছেলের স্ত্রী রুপিয়া জানান, কোন অবহেলা করা হয় না। সকলেই যত্ন নেন কোন অবহেলা নেই। তবে মেয়েরা সম্পদ থেকে বঞ্চিত ও তার গচ্ছিত টাকা হাতিয়ে নিতে না পেরে মাকে দেখভাল করেন না উপরন্ত নানা ধরনের ভিডিও করে ফেসবুকে ছেড়ে সম্মানহানী করে।
প্রতিবেশি সাজিয়া খাতুন জানান, সন্তানদের কারো কোন অভাব নেই সংসারে। মেয়েরাও বেশ ধনি। টাকা পয়সার কারণে বৃদ্ধ মহিলাটাকে কেউ দেখে না। তিনি আরো জানান, গত শনিবার ছেলে ও মেয়েদের দ্বন্দ্বের কারণে তাকে রাস্তায় রেখে গেছে। ছেলের বউরা মেয়ের বাড়িতে রেখে আসলে মেয়েরাও বাড়ি থেকে রাস্তায় ফেলে রাখে। স্থানীয় লোকজনের প্রতিবাদে অবশেষে ছেলের বউরা বাড়িতে নিয়ে যান।
মেজ ছেলের স্ত্রীসহ অন্যান্যরা জানান, যতই আদর যত্ন করা হয়, তার পরও বাড়ির পাশে মেয়ে আছে তার কাছে যাওয়া ও দেখার জন্য ছটফট করেন সাহেরা। মেয়েদেরকে খবর দেয়া হলেও তারা কেউ আসে না। এক পর্যায়ে শনিবার মেয়ের বাড়িতে দিয়ে আসা হয়। সম্পদ না পাওয়ার কারণে মেয়েরা বাড়িতে না রেখে রাস্তায় রেখে যায়। পরে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।
এ ব্যাপারে সাহেরার মেয়ে মেহেন্নীগার জানান, মাকে তার বাড়িতে না, বাড়ির পাশে রেখে যায় ভাবীরা। তারপর তাদের বাড়ির পাশে রেখে আসা হয়। মায়ের জমি জমা ফেরত দিলে তারাও মায়ের সেবা যত্ন করবেন বলে জানান। তিনি আরো জানান, মায়ের বিষয় নিয়ে গ্রামে ও কয়েকবার পুলিশ ক্যাম্পে সালিশ হলেও কোন সমঝোতা আসেনি।
এ ব্যাপারে কাউছার মেম্বর জানান, তার কাছে ৪০ হাজার টাকা গচ্ছিত আছে। যে কোন সময় চিকিৎসা বা তার দাফন কাফনে টাকাগুলো লাগতে পারে। তবে মেয়ের কাছে রাখা টাকাগুলো দিচ্ছেন না তারা। সালিশ বৈঠকেও কোন সুরাহা হয়নি।
গাংনী থানার ওসি আব্দুর রাজ্জাক জানান, এ ব্যাপারে কেউ কোন অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।