মানুষের শরীরে দৈনন্দিন অনেক পুষ্টির প্রয়োজন। বিভিন্ন খাদ্য থেকে পুষ্টির জোগান হয়। তারপরেও ঘাটতির কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ। পুষ্টির সমস্যা সমাধান হবে মাত্র ৩০ গ্রাম চিয়াতে । কথাটি শুনতে আমাদের কাছে বিষ্ময়কর মনে হলেও দক্ষিণ-পশ্চিম আমেরিকানদের কাছে সোনার চেয়েও ম্যূলবান এই চিয়া সীড। আমেরিকাতে এই ফসলকে সোনা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
মেহেরপুরের গাংনীতে এবার আবাদ করা হয়েছে চিয়া । কৃষি অফিসের তত্ত্বাবধানে উৎকৃষ্ঠ এগ্রো নামের একটি প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষামূলক আবাদে এসেছে বেশ সফলতা। গাংনী উপজেলা কৃষি অফিসার লাভলী খাতুনের নির্দেশনায় উপসহকারী কৃষি অফিসার শাহীন রেজা সার্বক্ষণিক দেখভাল করেন।
মানুষের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিসহ ক্যান্সার এবং ডায়াবেটিস প্রতিরোধী হিসেবে এর গুরু্ত্ব অপরিসীম। এই সুপার ফুড সেন্ট্রাল আমেরিকার প্রাচীন অধিবাসীদের কাছে সোনার চেয়েও মূল্যবান ছিল। বাংলাদেশে চাষের অপার সম্ভাবনা এবং কৃষি অর্থনীতিতে গরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে সুপার ফুড চিয়া।

চিয়া সীডের ফুল দেখতে আকর্ষণীয়। ছবি- মেহেরপুরের চোখ
চিয়া সীড এর উপকারিতা
গাংনী উপজেলা কৃষি অফিসার লাভলী খাতুন বলেন, এসডিজি এর একটি অংশ হচ্ছে পুষ্টি নিশ্চিত করা। সরকার খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি পুষ্টি নিরাপত্তার উপর জোর দিয়েছে। পুষ্টি বিবেচনায় চিয়া সীড আবাদ করা হচ্ছে। চিয়া সীডকে এক সময় সোনার খনি বলা হতো। শক্তির আধার হিসেবে দেখা হয়।
একজন মানুষ যদি প্রতিদিন ৩০ গ্রাম চিয়া সীড ভিজিয়ে খায় তাহলে পুষ্টির জন্য অন্য আর কোন খাবার দরকার নেই। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য ব্যধি প্রতিরোধে চিয়া সীড খুবই কার্যকরী। চিয়া সীডের গুনের কথা বলে শেষ করা যাবে না।
জানা গেছে, আমাদের দেশের মাটি ও আবহাওয়ায় চিয়া সীড আবাদ করা সম্ভব। গাংনী উপজেলা কৃষি অফিস চিয়া সীড আবাদের জন্য চাষীদের উদ্বুদ্ধ করছে। আগামি মৌসূমে বেশ কয়েকটি মাঠে আবাদের লক্ষ্য রয়েছে। খাদ্য তালিকায় অতি উত্তম হিসেবে গণ্য এই ফসল আবাদ সম্প্রসারণ এখন সময়ের দাবি। অতি উচ্চ মূল্যের এই ফসল আবাদে করে অনেক চাষী ভাগ্য বদল করেছেন।

গাংনীর সাহারবাটি মাঠে চিয়া সীড ক্ষেত পরিদর্শনে উপজেলা কৃষি অফিসার লাভলী খাতুন ও উপ সহকারি কৃষি অফিসার জুয়েল রেজা। ছবি- মেহেরপুরের চোখ
চিয়া সীড আবাদে লাখোপতি
গাংনী উপজেলা কৃষি অফিসার লাভলী খাতুন চাষের বিষয়ে বলেন, পরীক্ষামূলক চাষে ফলাফল অনেক ভালো। এ বছর দু’টি মাঠে আবাদ করা হয়েছিল। রবি মৌসূমে (কার্তিক মাসে) যথা সময়ে আবাদ করতে হবে। দানাদার ফসল হিসেবে এর তেমন পরিচর্যা লাগে না। সরিষা, মসুর চাষের মতই স্বাভাবিক পদ্ধতিতে আবাদযোগ্য। এক বিঘা জমিতে খরচ ৮-১০ হাজার টাকা। আর বিক্রি হয় ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত।
উচ্চমূ্ল্যের ফসল হিসেবে কেউ যদি খামার করতে চান তাহলে আর দেরি নয়। কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে যাবতীয় পরামর্শ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেনে এই কৃষিবীদ।
জেনে আসতে পারেন কালোজিরার উপকারিতা সম্পর্কে।
চিয়া সীড কোথায় পাওয়া যায়
খাওয়া ও চাষাবাদের জন্য চিয়া খুঁজে পেতে বেগ পোহাতে হয়। প্রচলিত ফসল নয় বিধায় এর গুনগত মান আর সঠিক জাত নিয়ে শংকা থাকা স্বাভাবিক। তাই এর প্রতি আগ্রহ থাকলেও সঠিক দিকনির্দেশনা আর বীজ প্রাপ্তির দুষ্প্রাপ্যতার কারণে আগ্রহীরা থেমে যাচ্ছেন। তাই দেশের যেকোন কৃষি অফিসের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। গাংনী উপজেলায় চাষীদের কাছে বীজ রয়েছে। যা আগামি মৌসূমে আবাদের জন্য সংরক্ষিত। কৃষি অফিসের সাথে যোগাযোগ করলে বীজ গ্রহণ আর চাষের পরামর্শ পাওয়া যাবে। গাংনী উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
চিয়া সীড এর দাম
রাজধানীর বিভিন্ন সুপারশপ এবং অর্গানিক ফুড সেল করে এমন ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের কাছে চিয়া পাওয়া যায়। সেখানে ভিন্ন ভিন্ন দামে বিক্রি হয়ে থাকে। চিয়া বীজে অন্যান্য ফল ফসলের মতো নির্দিষ্ট বাজার নেই। যার ফলে নির্দিষ্ট দামও থাকে না। তবে মার্কেটের বিভিন্ন বিষয় অনুসন্ধান করে গাংনীতে উৎপাদিত বীজের দর নির্ধারণ করেছেন কৃষকরা। প্রতি কেজি ৬০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয় বলে জানিয়েছেন গাংনী উপজেলা কৃষি অফিসার। বীজের গুনগতমান এবং প্রাপ্যতার উপর দর নির্ভর করে।
চিয়া সীড এর গাছ
রবি মৌসূমের ফসল তাই এ মৌসূমের অন্যান্য ফসলের সাথে চিয়া সীড গাছের বেশি মিল রয়েছে। মাঝারি আকারের সরিষা গাছের মতই লম্বা হয়। একটি গাছে বেশ কিছু ডালপালা থাকে। প্রতিটি ডালের শাখা থেকে আধা ফুট নিচ পর্যন্ত ফুল আসে। বেগুনি-সাদা রংয়ের ফুল বেশ দর্শণীয়। এই ফুল পড়ে গেলেই বীজ তৈরী হয়। তিল, তিসির আকারের মতই দেখতে হয় এই চিয়া।

গাংনীর সাহারবাটি মাঠে পরক্ষীমূলকভাবে আবাদকৃত চিয়া সীড ক্ষেত। ছবি- মেহেরপুরের চোখ
চিয়া সিড চাষ পদ্ধতি
গাংনী উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে যে দু’টি প্লটে আবাদ করা হয়েছে তার সফলতায় কৃষি বিভাগ বেজায় খুশি। চাষাবাদের বিষয়ে সংশ্লিষ্ঠরা বলেন, সরিষা, মসুর চাষের প্রক্রিয়ার মতই নতুন এই ফসলের আবাদ পদ্ধতি। আবাদের ক্ষেত্রে তেমন কোন পার্থক্য নেই। সার ও কীটনাশক ব্যবস্থাপনাও প্রায় একই। তবে খেয়াল রাখতে হবে সময়মতো বপণ আর নির্দিষ্ট দিনে সেচের দিকে। যেহেতু নতুন আবাদ হচ্ছে তাই ক্ষেতের দিকে বেশি বেশি নজর রাখতে হবে। ভাইরাস কিংবা ছত্রাকের আক্রমণ হলে জরুরী ভিত্তিতে প্রতিকার ব্যবস্থা প্রয়োজন। এছাড়াও তেমন কোন বিষয় নেই। আমাদের দেশের অন্যান্য ফসলের মতই খুব সহজ পক্রিয়ার মাধ্যমে এই ফসল আবাদযোগ্য।

গাংনী উপজেলার সাহারবাটি মাঠে চিয়া সীড ক্ষেত। ছবি- মেহেরপুরের চোখ
চিয়া কোথা থেকে আসলো
চিয়া বীজ বা চিয়া সীড হচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিম আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর সালভিয়া কলম্বিয়ারিয়া ফুলের একটি গোত্র। সাদা ও কালো উভয় প্রকৃতির হয়ে থাকে। প্রাক-কলম্বিয়ার যুগে অ্যাজটেকদের দ্বারা ফসলের ব্যাপক চাষ করা হতো। মেসোয়ামেরিকানদের প্রধান খাদ্য ছিল চিয়া। আমেরিকা এবং গুয়াতেমালায় অল্প পরিমাণে চাষ করা হতো। মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আবাদ করা হয়।
বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য নিয়ে এখন তেমন সমস্যা নেই। তবে এখনো নিশ্চিত হয়নি পুষ্টিসম্মৃদ্ধ খাবার। চিয়া সীড আবাদের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের পুষ্টি নিশ্চিত হবে। অপরদিকে আবাদ করে ঘুচতে পারে কোন বেকারের বেকারত্ব। পাশাপাশি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে খামার করেও কৃষি ব্যবসা হিসেবে এই দানাদার ফসল সোনার দানা (অনেক টাকা) এনে দিতে পারে। এমনটি প্রত্যাশা কৃষিবীদদের।
-এম.এইচ মানিক
mazdedulhaquemanik@gmail.com
ভিডিও দেখুন: