মেহেরপুরের চোখ ডট কম:
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মের পেছনে যে ঘটনাটি যুদ্ধের মোড় পাল্টে দেয় তা হচ্ছে মুজিবনগর সরকার। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল এ সরকার গঠন করা হয়। এই সরকার ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা (পরবর্তীতে মুজিবনগর নামকরণ) আম্রকাননে শপথ গ্রহণ করে। যার নেতৃত্বে নয় মাস যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন ইয়াহিয়া খানের শাসনামল ছিল।
পূর্বপাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। এর পরেও ক্ষমতা দেওয়া হয়নি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে।
এ নির্বাচনের ফলাফল কেন্দ্র করেই মূলত স্বাধীনতা যুদ্ধের গতি পরিধি বাড়তে থাকে। অপরদিকে বাঙালিদের দমনে আরও শক্ত অবস্থানে হামলা শুরু করে পাক সেনারা।
২৫ মার্চ কালো রত্রিতে পাক সেনাদের বর্বরোচিত গণহত্যা শুরু হয় এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে করাচিতে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে রাত ১২ টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। গ্রেফতারের আগেই তিঁনি আওয়ামী লীগ নেতাদের সরকার গঠন ও যুদ্ধ পরিচালনার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অন্যতম। এ নির্বাচনের ফলাফল সরকার গঠনে বাধ্য করে।
মুজিবনগর সরকার কেন গঠিত হয়
৩ এপ্রিল তাজ উদ্দীন আহমেদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রিরা গান্ধীর সাথে দিল্লিতে বৈঠক করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার বিষয়গুলো তুলে ধরে সহযোগিতা কামনা করেন। বৈঠক ফলপ্রসূ হলে তিঁনি পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে সরকার গঠনের উদ্যোগ নেন। মার্চে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনে প্রধানরাই সরকারে থাকবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন তিঁনি।
তাজ উদ্দীন আহমেদ যখন অন্য নেতাদের খুঁজতে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন তখন সেই নেতারা তাঁকে খুঁজতে ভারতে চলে গেছেন। একে অপরের খোঁজ নিয়ে ১০ এপ্রিলের আগে তাঁরা ভারতে মিলিত হন।
এদিকে বিপ্লবি কাউন্সিলর গঠন করার দাবি ছিল আওয়ামী লীগের যুবদের কাছ থেকে। এ কাউন্সিলের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ গণতান্ত্রিক দেশের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। একথা ভেবে ৭০ এ নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতের ক্ষমতা হস্তান্তরের আন্দোলন হিসেবে সরকারের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন তাজ উদ্দীন আহমদ। যা বিশ^ মন্ডলে গ্রহণযোগ্যতা পায় এবং বিভিন্ন দেশ এ সরকার সহযোগিতা দেয়।

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র
পৃথিবীর ইতিহাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের ছাড়া আর কোন দেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র নেই। অর্থাৎ এ দুই দেশ ছাড়া অন্য কোন দেশে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দিয়ে জন্ম লাভ করেনি। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের রচয়িতা।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সংবিধান প্রবর্তিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ১৫০ অনুচ্ছেদের আওয়তায় ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলী হিসেবে গণ্য হয়েছে। সংবিধানের সপ্তম তফসিলে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অন্তর্ভুক্ত করা আছে।
ঐতিহাসিক মুজিবনগর কমপ্লেক্সের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্সে একটি দেওয়াল স্তম্ভে এ ঘোষণাপত্র প্রদর্শন করা আছে।

মুজিবনগর সরকার কবে গঠিত হয়
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং ৭০ এর নির্বাচনের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল এ সরকার গঠন করা হয়। ছয় সদস্য নিয়ে এ সরকার গঠিত হয়েছিল। মন্ত্রীপরিষদ সদস্যদের নাম চুড়ান্ত করার পরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে নির্বাচিত করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে আটক থাকায় উপ রাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম দায়িত্ব পালন করেন।
এ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ।
অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী।
সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং কৃষি মন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান।
পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ।
মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে কর্নেল এম এ জি ওসমানী, মুক্তিবাহিনীর চিফ অব স্টাফ হিসেবে কর্নেল মোহাম্মদ আব্দুর রব এবং ডেপুটি চিফ অব স্টাফ উইং কমান্ডার হিসেবে আব্দুল করিম খন্দকারকে দায়িত্ব দেয় মুজিবনগর সরকার।

আরও পড়ুন মুজিবনগর একাত্তরের বাংলাদেশ
মুজিবনগর সরকারের নাম করণ
এ সরকারকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকা হয়। প্রবাসে গঠন হয়েছিল বলে প্রবাসী সরকার আর মুজিবনগরে শপথ হয়েছিল বলেই মুজিবনগর সরকার বলা হয়। কেউ কেউ অস্থায়ী সরকারও বলে থাকেন। তবে মুজিবনগর দিবেসের বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ প্রথম সরকার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই সরকারের অধীনে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। তাই বাংলাদেশের প্রথম সরকার হিসেবে নাম করণ করেছেন অনেকে।
সরকার গঠনের পরের চ্যালেঞ্জ
সরকার গঠনের পর ১১ এপ্রিল দেশবাসীর উদ্দেশ্যে প্রধামন্ত্রী তাজউদ্দীনের ভাষণ আকাশবাণী কোলকাতা বেতার প্রচার করে।
এর মাধ্যমে দেশবাসী জানতে পারেন যে স্বাধীনতা সগ্রামের জন্য একটি আইনানুগ সরকার গঠিত হয়েছে। এতে তাদের মনোবল দৃঢ় হয়। এ সরকারের নেতৃত্বে শুরু হয় দুর্বার মুক্তি আন্দোলন।
পাক শাসকরা অপপ্রচার চালাতে থাকে এ সরকার ভারতের কারসাজি। ফলে দেশের মধ্যে শপথ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন জাতীয় চার নেতা। ১৭ এপ্রিল দেশী বিদেশী সাংবাদিক, কুটনৈতিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার (বর্তমানে মেহেরপুর) বৈদ্যনাথতলা আমবাগানে শপথ গ্রহণ করে।
ছবি: সোহাগ মন্ডল, মুজিবনগর।